ড. আবদুল করিম : হারানো ইতিহাসের সন্ধানী
রিদুয়ানুল কবির সবুজ
চট্টগ্রাম জিলার প্রত্যন্ত প্রান্তের অঞ্চল বাঁশখালি। সমুদ্র উপকূলের এই অঞ্চলেই জন্ম নেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা ও গবেষনায় তার অবদান যে সর্বাধিক সেই বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষন করতে পারেননা। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধিন সুলতানি আমল এর ইতিহাস নিয়ে তাঁর কাজই এখন অন্যান্য গবেষকদের জন্য আকরগ্রন্থ। বৃটিশ আমলে উদ্দেশ্যমুলক ভাবেই বাংলার এই সম্বৃদ্ধ সময় কে মানুষের চোখের আড়ালে রাখা হয়েছিল। ডঃ করিম সেই চেপে রাখা ইতিহাস কে মানুষের সম্মুখে উপস্থাপন করেন।
এই মনিষির জন্ম বাঁশখালির চাঁপাছড়ি গ্রামে ১৯২৮ সালে। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি ভর্র্তি হন তৎকালিন নিউস্কিম মাদ্রাসা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এ। এই কলেজ অবস্থিত ছিল বর্তমান হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ এর জায়গায়। এখান থেকেই তিনি হাই মাদ্রাসা ও ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন সাফল্যের সাথে। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৫০ সালে এমএ পাস করার পর কিছুদিন নারায়নগঞ্জের মুড়াপাড়া হাই স্বুলে শিক্ষকতা করে ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এখানে প্রথমে রিডার(সহযোগি অধ্যাপক) হিসেবে যোগ দেন। পাশাপশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম হলের প্রভোস্ট ও ছিলেন। পরবর্তিতে কলা অনুষদ এর ডিন এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ২০০১ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরিটাস হন। ২০০৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় তিনি খেয়াল করেন যে ইতিহাস বিভাগের সিলেবাসে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ইতিহাস প্রায় অনুপস্থিত। এর পরের ১৭৫৭ পর্যন্ত ইতিহাস ও অনেক বিকৃত। পাস করার পর তিনি প্রথম চাকরি পান মুড়াপারা ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলে। এই মুড়াপারা বাংলার সুলতানি ও প্রাথমিক মোগল যুগে একটি গুরুত্বপুর্ন এলাকা ছিল। এখানে এই আমলের নিদর্শন গুলি দেখে তিনি বাংলার ইতিহাস এর এই ভুলে যাওয়া সময় চর্চার প্রেরনা পান। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি এই সময় এর ইতিহাস নিয়ে গবেষনার উদ্যোগ নেন। তার গবেষনা ছিল খুবই কঠিন কারন এই আমলের বিভিন্ন দলিল খুবই দুষ্প্রাপ্য। ভেজা ও উষ্ণ আবহাওয়ার বাংলাদেশে কাগজ বা এই জাতিয় জিনিস তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালিন অধ্যাপক এবং বিশ্ব বিখ্যাত ঐহিতাসিক ডঃ আহমদ হাসান দানির তত্বাবধানে তিনি ”সোস্যাল হিস্টরি অফ বেঙ্গল” নামে থিসিস লিখা শুরু করেন। ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন, প্রাপ্ত মুদ্রা ও শিলালিপির উপর নির্ভর করেন। দির্ঘ পরিশ্রম করে থিসিস টি তিনি শেষ করেন। ১৯৫৮ সালে থিসিস টি গৃহিত হয় এবং তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু পিএইচডির থেকে বড় প্রাপ্তি ছিল তিনি এই থিসিস টিতে তথ্য ও প্রমান সহকারে বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপুর্ন স্বাধিন সুলতানি আমল বিষয়ে অনেক তথ্য প্রথমবারের মত উপস্থাপন করে গবেষনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
এই বিশাল কাজটির পর তিনি ”করপাস অব দি মুসলিম কয়েনস ইন বেঙ্গল” নামে আরেকটি গবেষনা পুস্তক রচনা করেন। এই বইটিতে তিনি বাংলার বিভিন্ন সময় এর মুসলিম সুলতান ও শাসকদের দ্বারা প্রচলিত মুদ্রার ইতিহাস বিশ্লেষন করেন। তৎকালিন ঢাকা মিউজিয়াম এবং কয়েকজন ব্যাক্তি সংগ্রহকারির কাছে থাকা কয়েকশত মুদ্রা পরীক্ষা ও তার পাঠোদ্ধার এর বিশাল পরিশ্রমি কাজ করেন তিনি এই জন্য। প্রচলিত মুদ্রা থেকে অনেকগুলি তথ্য যেমন প্রচলনকারী সুলতান এর নাম, সাল, যে টাকশাল থেকে মুদ্রতি হয়েছে তার নাম ইত্যাদি পাওয়া যায়। যার মাধ্যমে শাসকের শাসনকাল এবং রাজত্বের বিস্তৃতি সঠিক ভাবে জানা যায়। এই বইটির মাধ্যমে বাংলার মুসলিম শাসকদের সময়কাল কে তিনি প্রথম নির্নয় করেন। এই রচনার জন্য তিনি ইন্ডিয়ান নিউমিজম্যাটিস সোসাইটি থেকে আকবর সিলভার মেডেলে সন্মানিত হন।
১৯৬০ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ তেকে দ্বিতিয়বার পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ” মুর্শিদকুলি খান এন্ড হিজ টাইমস” থিসিস লিখে। এই গবেষনার পর ও তার অনেকগুলি মৌলিক গবেষনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মুল ফার্সি থেকে অনুবাদ করেছেন ”ফুতুহাত ই ফিরোজশাহি” গ্রন্থটি। বাংলাদেশে ছাত্র ও ইতিহাস বিষয়ে উৎসাহিদের জন্য তার ”বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল”,’বাংলার ইতিহাস মোগল আমল” এবং ” বাংলার সামাজিক ইতিহাস” তিনটি অনন্য সাধারন গ্রন্থ। বাংলাদেশের ইতিহাস জানার জন্য এমন সংক্ষিপ্ত কিন্তু নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ আর নেই। বাংলা ও বিশ্বে বাংলার স্বাধিন সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনায় তার কাজকে ভারতের বিখ্যাত ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায় স্বিকৃতি দিয়েছেন তাকে তার একটি বই উৎসর্গ করে। সেই উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছেন বাংলার সুলতানি আমল সম্পর্কে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক হচ্ছেন ড. আবদুল করিম।
এই মহান ব্যাক্তি ইতিহাস গবেষনা ছাড়াও অনেক সামাজিক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। দুখন্ডে প্রকাশিত তার আত্মজীবনি ”সমাজ ও জিবন” তার জীবন এবং বৃটিশ শাসনামলের শেষ ভাগ থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস এ্র এক প্রত্যক্ষ দলিল। চাকরি ও সামাজিক জীবনে অনেক বিপদের সম্মুখিন ও হন তিনি। কিন্তু সকল পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যার মধ্যেও তিনি নিরলস ভাবে চালিয়ে গেছেন ইতিহাস গবেষনা। যা আমাদের জাতিসত্বার আত্মমর্যাদাবোধ কে জাগরিত রাখবে।
আজকে ২৪ এ জুলাই তার মৃত্যুবার্ষিকি।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে
১. স্যোস্যাল হিষ্টরি অফ মুসলমিস ইন বঙ্গেল( বাংলার মুসলিমদের সামাজিক ইতহিাস নামে বাংলায় প্রকাশিত)।
২. করপাস অফ দি মুসলমি কয়নেস ইন বেঙ্গল।
৩. র্মুশদিকুলি খান এন্ড হিজ টাইমস।
৪. ঢাকা দি মোগল ক্যাপিটাল।
৫. ঢাকাই মসলিন।
৬. শরিয়তনামা-নসরুল্লাহ খন্দকার(অনুবাদ ও সম্পাদনা)।
৭. ভারত উপমহাদশেে মুসলিম শাসন।
৮. বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল)।
৯. বাংলার ইতিহাস (মোগল আমল)।
১০. চট্টগ্রামে ইসলাম।
১১. মোল্লা মিসকিন শাহ।
১২. ফুতুহাত ই ফিরোজশাহি (অনুবাদ ও সম্পাদনা)।
১৩. বাংলার সূফী সমাজ।
১৪. মক্কা শরীফে বাঙ্গালি মাদ্রাসা।
১৫. রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপরখো।