মোবারক সাহেবের হজ্ব পালন
লম্বা টানা বারান্দায় পুরনো দু’তিনটা কাপড় বিছানো। এগুলোর উপর সারি বেঁধে পনেরো ষোলটা ছোট ছেলেমেয়ে বসে গোশত, রুটি, পরোটা খাচ্ছে। গোশতের ঝোল ওদের ঠোঁটের কোণা দিয়ে লালার মত ঝরে পড়ছে। কেউ হাতের উল্টো পিঠে, কেউ ময়লা ছেড়া পরনের কাপড়ে ও ফ্রকের প্রান্ত দিয়ে সেই ঝোল মুছে নিচ্ছে। হয়তো এভাবে গোশত-পরোটা খাওয়ায় অভ্যস্ত না বলে মুখ আর কাপড় ঝোলময় করে ফেলছে বাচ্চাগুলো। এসব দেখে পরনের সাদা ধবধবে পাঞ্জাবীর হাতায় বারবার চোখ মুছছেন মোবারক সাহেব। সেক্রেটারি রমিজ রুমাল এগিয়ে দিলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি তিনি। হয়তো আজকের এই দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চোখের পানির দাগ বসিয়ে দিতে চাচ্ছেন পাঞ্জাবীটায়। রান্না করা কোরবানীর গোশত সবার প্রথমে এই বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানো হচ্ছে। এরা সবাই এতিম শিশু। এরপর আরো অনেক কাজ বাকি আছে। পুরো গ্রামের সব হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে গোশত রুটি বিতরণ করবেন। তারপর আরো কয়েকটা এতিমখানার বাচ্চাদেরকেও খাওয়াবেন। তিনদিন পর্যন্ত এসব কাজ করে যাবেন মোবারক সাহেব। এসবে ব্যস্ত থেকে যদি হজ্ব করতে না পারার দুঃখটা ভুলে থাকা যায়, তিনি সে চেষ্টাই করছেন।
.
মোবারক সাহেবের ছেলেবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আকবর আলী। স্কুল, কলেজ সব এক সাথেই পার করেছেন তারা। যে কোন কাজেই একজন আরেকজনের পরামর্শ নিতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই দুজনের পরম বন্ধুত্ব কিভাবে যে চরম শত্রুতায় পরিণত হলো তা গ্রামের সবার কাছেই অজানা। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এই দুজনের নাম। যে কোন কাজে এরা প্রতিযোগিতা করতো। কার চেয়ে কে বেশি উপরে উঠতে পারবে এই নিয়েই দুজনের মধ্যে নীরব যুদ্ধ চলতো। একজন আরেকজনের ছায়া মাড়াতেন না সহজে তবে আড়ালে আবডালে ঠিকই খোঁজ খবর রাখতেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কী করছে। দুজনেই ব্যাপক অর্থ সম্পদের মালিক। কিছু পৈত্রিক আর কিছু নিজেদের অর্জন। মোবারক সাহেব বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আল্লাহভীরু হয়ে উঠছেন। কিন্তু আকবর আলী আগের মতই আছেন। শেয়ালের মতো ধূর্ত আর হিংসাপরায়ণ।
মোবারক সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবছর হজ্ব করতে যাবেন। জীবনে সব স্বপ্নই পূরণ করেছেন। শুধু দুটো স্বপ্ন বাকি থেকে গেছে। একটা হলো কলেজ জীবনের প্রথম প্রেম তাহুরাকে বিয়ে করা, যেটা আর কখনো সম্ভব নয়। তাহুরা এখন অন্য একজনের স্ত্রী। তাহুরার জন্যই মূলত দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছিল। আকবরও ভালোবাসতেন তাহুরাকে। কিন্তু দুজনের কেউই তাকে বিয়ে করতে পারেননি। সে এক অন্য ইতিহাস। মোবারক সাহেবের দ্বিতীয় স্বপ্নটা হলো মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্ব পালন করা। অর্থ সম্পদ তো কম হয়নি। এখন আর কিসের অপেক্ষা। যে হারে মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে তা ভেবে ভেবে মোবারক সাহেব সাতান্ন বছর বয়সেই মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত। এখন হজ্ব পালন করে নিজের গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারলেই তিনি শান্তিতে মরতে পারবেন। মোবারক সাহেব হজ্বে যাবেন এ খবরটি এ কান ও কান করে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল অল্প সময়ের মধ্যেই। যথারীতি আকবর আলীও জেনেছিলেন। এরপর তিনিও উঠে পড়ে লেগেছিলেন হজ্বে যাওয়ার জন্য।
.
নির্দিষ্ট দিনে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মোবারক সাহেব ঢাকা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। সেখান থেকেই তার ফ্লাইট। কিন্তু সেখানে গিয়েই অঘটনটা ঘটেছিল। বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় তিনি যে ট্যাক্সিটা ভাড়া করেছিলেন সেটা একজন পথচারীকে চাপা দিয়েছিল। ড্রাইভার গাড়ি না থামিয়ে স্পিডে চালিয়ে নিচ্ছিল তখন মোবারক সাহেবের বোধদয় হল। কি করছেন তিনি! একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে যাত্রাপথে একটা খারাপ কাজ করছেন! তিনি ড্রাইভারকে নির্দেষ দিয়েছিলেন, ‘গাড়ি ঘুরাও ড্রাইভার।’ ড্রাইভার বলেছিল, ‘চাচামিয়া আপনি পাগল হইসেন? এখন যদি গাড়ি ঘুরাই তাইলে আমগোরে আর এয়ারপোর্ট যাইতে হইব না, সোজা জেলে যাইতে হইব।’ মোবারক সাহেব কঠিন সুরে বলেছিলেন, ‘গাড়ি না ঘোরালে আমিই তোমাকে জেলে ঢুকাবো। যেটা বলেছি সেটা করো, গাড়ি ঘুরাও।’ অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলতে বলতে ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেখানে আহত ব্যক্তিটিকে আর পাওয়া যায়নি। আশেপাশে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানা যায় কাছের একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছেলেটিকে। মোবারক সাহেব সেখানে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলেন। হাসপাতালে গিয়ে ছেলেটির খোঁজ পেতে বিলম্ব হয়নি। গুরুতর আহত ছেলেটিকে হাসপাতালের করিডোরে ফেলে রাখা হয়েছিল। যতক্ষণ না তার কোন আত্মীয়স্বজন এসে হাসপাতালে ভর্তি না করায় ততক্ষণ পর্যন্ত নাকি চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব না। মোবারক সাহেব আত্মীয় পরিচয়ে ছেলেটিকে ভর্তি করিয়েছিলেন এবং যাবতীয় খরচ নিজেই বহন করেছিলেন। এরপর ছেলেটির বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছেলেটির পরিবারের লোকজন হাসপাতালে ছুটে এসেছিল, সেই সাথে পুলিশ। রোড অ্যাক্সিডেন্ট বলে কথা। মোবারক সাহেব অকপটে সব ঘটনা খুলে বলেছিলেন, গাড়ির নাম্বারটাও পুলিশকে দিয়েছিলেন। এরপর তেমন কোন ঝামেলা হয়নি। ডাক্তার ছেলেটিকে আশঙ্কামুক্ত বলার পর সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু এদিকে মোবারক সাহেবের ফ্লাইট মিস হয়ে যায়। এরপর মাত্র আর একটাই ফ্লাইট ছিল দুদিন পর। কিন্তু সেটাও ধরতে পারেননি নানা জটিলতায়। ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠলে পঞ্চম দিন মোবারক সাহেব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে গ্রামে ফিরে যান।
.
‘স্যার, ওদের খাওয়া শেষ। এখন আপনি কিছু খেয়ে নেন।’ রমিজের কথায় ধ্যান ভাঙল মোবারক সাহেবের। চোখে এখনও পানি। আজ তিনি হয়তো মক্কায় হাজীদের সাথে কোরবানী করতে পারতেন। কিন্তু সেটা আর হলো না, এ কথা মনে হতেই চোখ বারবার ভিজে উঠছে। চোখ মুছে নিয়ে বললেন, ‘আগে গ্রামের গরীব ঘরগুলোতে যাই, সেখানে গিয়ে ওদের সাথেই খাবো।’ ভ্যান গাড়িতে বড় বড় চারটা ডেকচি তোলা হলো। মোবারক সাহেব বের হবেন এমন সময় শুনলেন একটা ছেলে বলছে, ‘আইজ অনেকদিন পর মজা কইরা ভালা কইরা খাইলাম।’ আরেকজন বলছে, ‘হ, এতিম খানায় খাওন তো মেলা আহে, কিন্তু আমরা এতো ভালা কইরা কখনো খাইবার পারি নাই। মানুষডা বড় ভালা।’ প্রথমজন আবারো বলল, ‘ঠিক কথা, তার মনডা আসলেই বড়। কিন্তু আমরা যখন খাইতাছিলাম তখন তিনি কানতাছিলেন ক্যান?’ এবার তৃতীয় একজন বলল, ‘ক্যান তোরা জানস না, উনি হজ্বে যাইতে পারেন নাই? কিন্তু আকবর আলী হজ্বে গ্যাছে। হেল্লাইগাই তো এমুন কইরা কাঁন্দে।’ ছেলেটার কথায় প্রচণ্ড অবাক হন মোবারক সাহেব। এইটুকু ছেলে এভাবে কথা বলতে পারলো! নিশ্চয়ই বড়দের কারো কাছ থেকে শুনেছে। অথচ মোবারক সাহেবের মনে এসবের ছিটেফোটাও নেই। গ্রামের লোক তার সম্পর্কে এরকম ধারণা করে ভেবে মোবারক সাহেব মনে মনে অনুতপ্ত হলেন। মনে দুঃখ নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন গোশত বিতরণের উদ্দেশ্যে।
.
পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল আকবর আলীর ছোট ভাই আমজাদ আলীর সাথে। আমজাদ আলী সালাম দিল। অন্যদিন হলে মোবারক সাহেব কথা বলতেন না। কিন্তু আজ ঈদের দিন, কথা না বলাটা বড় অন্যায় হয়ে যাবে। তিনিও সালামের জবাব দিলেন। কুশলাদির পর আমজাদ মোবারক সাহেবের ক্ষতস্থানে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘শুনেছি আপনি নাকি এবার হজ্বে যেতে চেয়েও যেতে পারেন নি?’ মোবারক সাহেব নীরব হয়ে রইলেন। মুখে চুকচুক জাতীয় একটা শব্দ করে আমজাদ আবারো বলল, ‘বড় ভাইজান তো এখন হজ্ব করছেন। আসলে সব তকদিরের খেলা। বড় ভাইজানের তকদিরে হজ্ব লেখা ছিল আর আপনার তকদিরে ছিল না।’ বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করল। যেন খুবই হাসির কথা বলেছে সে। সে আশা করেছিল এবার হয়তো মোবারক সাহেব ক্ষেপে গিয়ে কিছু একটা বলে ফেলবেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মোবারক সাহেব বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ আমজাদ। আমার তকদিরে ছিল না। হয়তো আল্লাহ আমার উপর অন্য কোন কাজের ভার অর্পন করতে চেয়েছেন, আমি হজ্বে গেলে হয়তো সেটা করা হতো না। আল্লাহ নেক হায়াত দান করলে ইনশাআল্লাহ আগামী বছর হজ্ব পালন করতে পারবো। এখন আসি। বাড়িতে যেও। আল্লাহ হাফিজ।’ আমজাদকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মোবারক সাহেব ড্রাইভারকে ইশারা করলেন গাড়ি ছাড়ার জন্য। সাইড মিররে দেখতে পেলেন আমজাদ তখনও হতবুদ্ধির মতো একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
.
১২ জিলহজ্ব, কোরবানের তৃতীয় দিন। গভীর রাত, মোবারক সাহেব জায়নামাযে বসে কাঁদছেন। গত তিন দিন ধরে তিনি অনেক দান খয়রাত করেছেন, কোরবানীর গোশতের সিংহভাগ গরীব দুঃখীদের মাঝে বণ্টন করেছেন। এগুলো পেয়ে যখন অসহায় মানুষগুলোর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটতো, গরীব এতিম ছেলেগুলো নিজেদের পেটে হাত বুলিয়ে নিষ্পাপ হাসি দিত, তখন মোবারক সাহেবও হজ্ব করতে না পারার ব্যথাটা বেমালুম ভুলে যেতেন। কিন্তু রাতে ঘুমাতে গেলেই সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে, অ্যাক্সিডেন্টটা না হলে মোবারক সাহেবের ফ্লাইট মিস হতো না। আচ্ছা সব তো আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। এ ঘটনার পেছনে আল্লাহর কী ইচ্ছা ছিল? মোবারককে হজ্ব করতে না দেয়া? নাকি আল্লাহ তাকে কোন পরীক্ষা করছেন? আর ভাবতে পারেন না মোবারক সাহেব। কান্নায় ভেঙে পড়েন, মনে একরাশ ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, ‘হে আল্লাহ আমি গুনাহগার বান্দা বলে কি তুমি আমাকে ঐ পবিত্র ভূমিতে কদম রাখতে দাওনি? আমি কি এতই পাপ করেছি যে তুমি আমাকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করা থেকে বিরত রাখলে? হে আল্লাহ যদি তাই হয় তবে তুমি আমাকে ক্ষমা করো, আমার সকল গুনাহর জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছি। আমাকে ক্ষমা করো আল্লাহ।’ কাঁদতে কাঁদতে একসময় জায়নামাযেই ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন তিনি একটা স্বপ্ন দেখলেন, তিনি এবং আকবর সাহেব দুজনে কোলাকুলি করছেন। দুজনের গায়েই ছিল হাজীদের পোশাক। ফযরের আজানের সময় মোবারক সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নটার কথা মনে হতেই তিনি মনে অদ্ভুদ প্রশান্তি অনুভব করতে লাগলেন। তারপর প্রতিদিনের মতো বাড়ির অন্য ছেলেদের ঘুম থেকে ডেকে একসাথে সবাই মসজিদে গেলেন।
.
নিজের রুমে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন মোবারক সাহেব, তখন বেলা এগারোটা। হঠাৎ চেচামেচির শব্দ শুনতে পেলেন, রমিজ কার সাথে যেন বাড়াবাড়ি করছে। তিনি বাইরে এসে দেখলেন আমজাদ আলী এসেছে। তাকে দেখে মোবারক সাহেব রীতিমত অবাক হলেন। বড় ভাইয়ের সাথে শত্রুতা থাকায় আমজাদ এ বাড়িতে আসে না বহু বছর। আজ হঠাৎ কী মনে করে এসেছে! মোবারক সাহেবকে দেখে রমিজ উৎসাহ পেল, গলা চড়িয়ে বলল, ‘দেখেন না স্যার, কতবার বললাম যে, আমার স্যার আরাম করছেন। এখন দেখা করা যাবে না। বিকেলে আসবেন। কিন্তু উনি কোন কথাই শুনতে চাচ্ছেন না।’ মোবারক সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ‘রমিজ বাড়ির মেহমানকে ফিরিয়ে দেয়ার মতো ভুল দ্বিতীয়বার আর করবে না। আমজাদ তুমি ভেতরে এসো।’ কথাটা শুনে আমজাদ রমিজকে প্রায় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। মোবারক সাহেব আমজাদকে বসতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব খবর ভালো তো? আকবর কেমন আছে? ওর ফিরতি ফ্লাইট কবে?’ আমজাদ নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘আমি আসলে ভাইজানের খবর নিয়েই আপনার কাছে এসেছি। ভাইজান আপনার সাথে কথা বলতে চান।’ কথাটা শুনে মোবারক সাহেব চমকে উঠলেন। এতোবছর পর আকবর তার সাথে কথা বলতে চাইছে! তাও সুদূর মক্কা থেকে! কোন অসুবিধা হয়নি তো আকবরের? ঘর কাঁপানো রিংটোনের শব্দে মোবারক সাহেবের সাময়িক দুশ্চিন্তার অবসান ঘটল। আমজাদের মোবাইলে কল এসেছে। আমজাদ রিসিভ করেই মোবাইলটা মোবারক সাহেবের দিকে এগিয়ে দিল। কাঁপা হাতে মোবাইলটা নিয়ে নিজ কানে ধরলেন মোবারক সাহেব। ওপাশ থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হ্যালো দোস্ত।’ মোবারক সাহেব ধরা গলায় উত্তর দিলেন, ‘আকবর, ভালো আছিস দোস্ত?’ ওপাশ থেকে আকবর বলে যেতে লাগলেন, ‘দোস্ত আমাকে ক্ষমা করে দিস। ভুল বুঝে তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি।’ ‘দোষ তো আমারও ছিল। আমিও কি তোকে ভুল বুঝিনি? তুইও আমাকে ক্ষমা করিস দোস্ত।’ আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন মোবারক সাহেব। দু’বন্ধুতে কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর আকবর প্রশ্ন করলেন, ‘বন্ধু, আমি যেদিন এখানে পৌঁছেছি সেদিনই জানতে পেরেছিলাম তুই আসতে পারিসনি। কিন্তু কেন আসতে পারিসনি সেটা জানতাম না। কী হয়েছিল সেদিন?’ মোবারক সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সেদিনের দুর্ঘটনার কথা বর্ণনা করলেন। সব শুনে আকবর বিস্ময়ে ফেটে পড়লেন, ‘এসব কী বলছিস? তুই তো ছেলেটার কাছে না গিয়ে ফ্লাইট ধরতে পারতি। তুই এমন করেছিস কেন?’ মোবারক সাহেব জবাবে বললেন, ‘আমি তখন ভেবেছিলাম হজ্বে যাচ্ছি আমার সব গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু যাওয়ার পথেই এতবড় গুনাহ কিভাবে করে যাব? হ্যা তুই হয়তো বলবি, আমি তো হজ্বে গিয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে আল্লাহ মাফ করে দিতেন। কিন্তু দোস্ত ছেলেটার কিছু হলে তার পরিবার যে সারাটা জীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতো, এবং তাদের সারাজীবনের চোখের পানির জন্য আমিই দায়ী হতাম। আমি তো পরের বছর হজ্বে যেতে পারবো কিন্তু ঐ মুহূর্তে ছেলেটাকে না বাঁচালে তার পরিবার কি তাকে আর ফিরে পেত? আর আমিও তো জানতে পারতাম না কখনো ছেলেটা বেঁচে গিয়েছিল নাকি মারা গিয়েছিল। সারাজীবন অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো।’ আকবর আলী বললেন, ‘কিন্তু তোর অপরাধ ছিল কোথায়? অপরাধ তো করেছে ড্রাইভার।’ মোবারক সাহেব হেসে বললেন, ‘কিন্তু ঐ গাড়িতে আমিও ছিলাম। একজন আহত ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে গেলে আমি আরো বেশি অপরাধী হতাম। তাছাড়া ড্রাইভার অপরাধ করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি যদি সেদিন ছেলেটার কাছে ফিরে না যেতাম তাহলে ড্রাইভারের অপরাধকে চাপা দেয়া হতো, তখন আমিও কি একই অপরাধে অপরাধী হতাম না?’ একটু থেমে মোবারক সাহেব আবারো বলতে লাগলেন, ‘সব থেকে বড় কথা কি জানিস? সেদিন সেই ছেলেটার অ্যাক্সিডেন্ট হওয়াটা আগে থেকেই আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। আর তিনি আমি যে গাড়িতে উঠেছি সেই গাড়ির দ্বারাই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটিয়েছেন আমাকে পরীক্ষা করার জন্য। দুনিয়াটা তো পরীক্ষা ক্ষেত্র। সেদিন আমি গুনাহ মাফ করিয়ে নিব এই চিন্তা করে ছেলেটাকে মরার জন্য ছেড়ে আসলে ওটা হতো শয়তানের ধোঁকা। আলহামদুলিল্লাহ আমি শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম সেদিন। হজ্ব করতে পারিনি এজন্য মনে অনেক দুঃখ আছে তবে এটা ভেবে সান্ত্বনা পাই আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার জন্য উত্তম কিছু রেখেছেন।’ কথাগুলো শুনে আকবর আলী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না, ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলেন। মোবারক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘আকবর তুই কাঁদছিস কেন?’ আকবর আলী বললেন, ‘বন্ধু আল্লাহ তোর হজ্ব কবুল করে ফেলেছেন।’ মোবারক সাহেব ভাবলেন হয়তো তার সব কথা শুনে আকবরের খারাপ লাগছে তাই নিজেকে ও তাকে সান্ত্বনা দিতেই বলেছে কথাটা। তিনি বললেন, ‘দুঃখ করিস না, পরেরবার ইনশাআল্লাহ হজ্ব করতে যাব।’ আকবর বলে উঠলেন, ‘না না দোস্ত আমি সত্যি বলছি আল্লাহ তোর হজ্ব কবুল করেছেন। আমি আজ কেন তোর সাথে কথা বলছি সেটা জানতে চাইবি না?’ মোবারক সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। আসলেই তো এতোবছর পর আকবর কেন তাকে ফোন করল এটাও কৌতুহলের বিষয়। আকবর জবাবের অপেক্ষা না করে বলে যেতে লাগলেন, ‘প্রথম দিন থেকে হজ্বের প্রতিটি কার্যক্রমে আমি তোকে এখানে দেখেছি। প্রথম দিন মনে করেছি চোখের ভুল অথবা একই চেহারার অন্য মানুষ তো হতেই পারে। কারণ আমি জানতাম তুই আসতে পারিস নি। কিন্তু যখন প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় তোকে দেখতে লাগলাম আমার মনে হতো ওটা তুই। আর তোকে সবকিছুতেই অগ্রগামী দেখতাম। তোকে অনেক ফলো করতাম কিন্তু ভীড়ের মাঝে আবার হারিয়ে ফেলতাম। আর গতরাতে একটা আজব স্বপ্ন দেখলাম। মসজিদুল হারামে তুই একাকী সালাত আদায় করছিস। তোর চারপাশ অন্যরকম একটা আলোয় আলোকিত হয়ে ছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন শেষরাত। ভাবলাম তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতে যাই। যখন মসজিদুল হারামে গেলাম তখন ওখানে কয়েকজন হাজী তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করছিল। কিন্তু কিছু দূরে আরেকজন হাজী একাকী সালাতে মগ্ন ছিল। তাকে দেখে আমার কৌতুহল হলো। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম হাজীটা আর কেউ নয়, তুই। তোর নামায শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যাবে ভেবে আমি তোর পাশেই নামাযের জন্য দাঁড়ালাম। কিন্তু নামায শেষে সালাম ফিরিয়ে দেখলাম আমার পাশে কেউ নেই। অন্য হাজীদের কাছে তোর ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা কেউই সঠিকভাবে কিছু বলতে পারেনি। আজ ফোনে আমজাদের সাথে কথা বলে আবারও জানতে পারলাম সত্যিই তুই হজ্ব করতে আসতে পারিসনি। আমি ওকে বললাম আমি তোকে এখানে বহুবার দেখেছি। বিশেষ করে গত রাতের ঘটনাটা বললাম। কিন্তু ও বিশ্বাস করলো না। তখন আমি ওকে বললাম সত্যিই যদি মোবারক দেশে থেকে থাকে তাহলে আমার সাথে কথা বলিয়ে দে। ও প্রথমে রাজি হয়নি। পরে আমার জোরাজুরিতে তোর বাড়িতে গেছে। ফোনে তোর কণ্ঠ শুনে আমি প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এখানে যা দেখেছি সব মনের ভুল বলে মনে হতে লাগল। কিন্তু পরে তোর সব কথা শুনে বুঝলাম আমি যা দেখেছি তাই সত্য। তুই স্ব-শরীরে হজ্বে না এলেও তোর মহৎ চিন্তা এবং কাজের জন্য আল্লাহ তোর হজ্ব কবুল করেছেন। আর হজ্ব করতে না পারায় তুই যে দুঃখ করছিস এজন্য আল্লাহ তোর কাছে এ সুসংবাদটা পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য আমাকে উছিলা বানিয়েছেন। তাই বারবার আমি তোর মতো কাউকে এখানে দেখেছি।’ মোবারক সাহেব সব শুনে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘তুই এতোক্ষণ যা বললি সব কি সত্যি?’ আকবর আলী বললেন, ‘দোস্ত আল্লাহর দোহায় আমাকে অবিশ্বাস করিস না, আমি যা বলেছি সব অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।’ মোবারক সাহেব এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে উঠলেন। তার কান্না শুনে আকবর আলীও কাঁদছেন। এ কান্না হজ্ব করতে না পারার কান্না না, এ কান্না খুশির কান্না, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের খুশি। মোবারক সাহেব ক্রন্দনরত অবস্থায়ই বললেন, ‘আকবর দোস্ত ক্ষমা চাই এখন আমাকে রাখতে হবে। আমি শুকরিয়ার নফল নামায পড়ব। আমাকে ফোন করে এই সুখবরটা দেয়ার জন্য তোকেও অনেক শুকরিয়া।’ আমজাদ আলী বললেন, ‘বন্ধু আমি সারাজীবন যত গুনাহ করেছি জানিনা আল্লাহ আমার হজ্ব কবুল করবেন কিনা। এই হজ্ব করতে আসার উদ্দেশ্যও ছিল লোক দেখানো আর তোর সাথে প্রতিযোগিতা করা। আমি এই মুহূর্ত থেকে অনুতপ্ত মনে সব কিছুর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব। তুইও আমার জন্য দোআ করিস। তুই আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দাদের একজন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ হাফিজ।’ ফোন রেখে দিয়ে মোবারক সাহেব ওযু করতে গেলেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাতে তিনি আর তিল মাত্র বিলম্ব করতে চান না।