সুখ তোমার মোহে
সালসাবিলা নকি
আজকের পত্রিকার প্রধান শিরোনাম,
 ‘সুখ খুঁজতে গিয়ে সারাদেশে একদিনে তিনটি অপমৃত্যু’
বিস্তারিততে বলা আছে,
ঢাকার মিতালী দেবী, একান্ন বৎসর বয়স। বনেদী পরিবারের গৃহবধু সে।
 বড় মেয়ে রমার স্বামী নামকরা ডাক্তার। সম্প্রতি পিএইচডি করতে বিলাতে গেছে,
 সাথে নিয়ে গেছে রমাকেও।
 মেয়েটা বড় সুখেই আছে সেখানে।
 মেঝ ছেলে দীপন পড়ে নামকরা ভার্সিটিতে,
 ফার্মেসির দ্বিতীয় বর্ষে।
 ছোট ছেলেটার এবার মেট্রিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে,
 গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে মিতালী দেবীর নাম রেখেছে সে।
 ছেলে মেয়ে নিয়ে তার সুখেই থাকার কথা ছিল।
 কিন্তু প্রায়ই দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে দুঃখের অনল!
 কীসের দুঃখ মিতালী দেবীর!
 যখন জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির বৌটাকে দেখে স্বামীর সাথে রঙ্গ করতে, অথবা, বিকেল বেলায় যখন ঐ জুটি বারান্দায় বসে চা খায়,
 কিংবা প্রায়ই রাতে জানালার পর্দা টেনে রঙিন আলো জ্বালিয়ে মেতে উঠে সুখ সঙ্গমে,
 মিতালী দেবী জ্বলে পুরে ছারখার হয়।
 প্রতিরাতে তার স্বামী দীনেশ রায় যখন অফিসের একগাদা কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে,
 সে অভিযোগ করে, বিয়ের তেত্রিশ বছরেও সে সুখ পায়নি।
 সব দিয়েছে দীনেশ, শুধু ব্যস্ততার অজুহাতে তাকে সময় দিতে পারেনি।
 ঘটনার দিন রাতে, একথা সেকথা নানা কথা কাটাকাটিতে দীনেশ দুটো চড় দিয়েছিল,
 মিতালী দেবী অমনিই কীটনাশকের বোতল উপুড় করে গলায় ঢেলে দিল।
 কেউ পারেনি তাকে বাঁচাতে।
 ছেলেমেয়ে নিয়ে কান্নারত দীনেশ বলেছিল, ‘মিতালী শুধু সুখ চেয়েছিল, স্বামীর সুখ!’
সুখ পায়নি বলে অভিযোগ করতো তালেব রহমানও।
 মাছের খামার, মুরগির ফার্ম আরও ছোট খাটো কত ব্যবসা ছিল তার!
 তিন তিনটে বিয়ে করেছিল শুধু সন্তানের আশায়।
 কপাল মন্দ ছিল তার! তিন বউই বন্ধ্যা।
 মনের দুঃখে প্রায়ই সে তিন বউকে একসাথে পেটাতো।
 সইতে না পেরে ছোট বউটা সেদিন বলেই ফেলেছিল, ‘আমরারে না পিডাইয়া আপনে ডাক্তার দেহাইতে পারেন না?’
 কথাটা শুনেই থমকে গিয়েছিল তালেব রহমান!
 এতবড় কথা! কিন্তু মিথ্যে তো নয়!
 সেদিন এশার নামাজের পর নিজের বাগানের আমগাছে ঝুলে পড়েছিল সে।
 পৌরুষত্বে আঘাত এসেছিল তার,
 সইতে পারেনি।
মৃত্যুর আগেও বারবার মনে হয়েছিল,
 তিনটে বিয়ে না করলেই সে পারতো।
 শুধু সুখের জন্যই এতগুলো জীবন নষ্ট হলো, সন্তানের সুখ!
বারো বছরের স্বর্ণা।
 মিষ্টি চেহারা।
 ছিল পাখির মতো চঞ্চল স্বভাবের।
 পড়ালেখায় ছিল তুখোর মেধাবী।
 কিন্তু মাত্র বারো বছর বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল, সুখ নামক একটা সোনার হরিণ আছে।
 যার পেছনে ছুটছে সবাই,
 বাপি, মামনি, ভাইয়া আর পৃথিবীর সব মানুষ।
 সোনার হরিণটা কি সবাইকে ধরা দেয়?
 নাহ্। মামনি, বাপি সব সময় তাগাদা দেয়, ‘খুব বেশি করে পড়াশোনা করতে হবে।
 ভাইয়ার মতো জেএসসি, এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেতেই হবে।
 নাহয় সমাজে নাকি মুখ দেখানো যাবে না।
 জীবনে ভালো কিছু করা যাবে না।
 এসবের মধ্যেই তো সুখ।
 স্বর্ণা পারেনি গোল্ডেন এ প্লাস আনতে। তাই তো চুপিচুপি চলে গেছে না ফেরার দেশে।
 হোমওয়ার্কের খাতায় লিখে গেছে, ‘আমার জন্য তোমাদের মুখ লুকাতে হবে না।
 স্বর্ণার রেজাল্ট কী, কোথায় পড়ে এসব কিছুই আর সমাজের মানুষকে কষ্ট করে বলে বেড়াতে হবে না।
 তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য ভাইয়া আছে, ওকে নিয়েই সুখে থেকো।’
আমি পত্রিকার পাতা ভাঁজ করে রেখেদিলাম টেবিলে।
 আচ্ছা শুধু কি এই তিনটে মাত্র মৃত্যু হয়েছে?
 প্রতিদিন প্রতি ঘরে ঘরে কত প্রাণ যাচ্ছে এই সুখ সুখ হাহাকারে!
 পত্রিকায় কটা আসে!
 বোকা মানুষগুলো জানে না, সুখ কোথাও নেই।
 যে স্বামীসঙ্গ পায় সেও কাঁদে, হয়তো অন্য কোন কারণে।
 হয়তো তার কঠিন কোন রোগ আছে, হয়তোবা তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
 মিতালী দেবী জানতো না সুখী জুটিটাও আড়ালে আবডালে কাঁদে।
 তালেব রহমান কবরে শুয়ে কি জানবে কখনো, অনেক পিতাই নিজের সন্তানকে রোজ অভিশাপ দেয়!
 অবাধ্য সন্তান হওয়ার চেয়ে নিঃসন্তান হলে ভালো হতো’ এমন ভাবনা কুড়ে কুড়ে খায় অনেককে।
 তিন সুযোগ্য সন্তান থাকার পরেও অসুখী ছিল মিতালী দেবী।
 স্বর্ণা বেঁচে থাকলে হয়তো ওর মা বাবাকে প্রমাণ করে দিতে পারতো, ‘অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এসবে সুখ নেই।
 সুখ কোথাও নেই।
 আবার সুখ সবখানেই।
 প্রতিটা মানুষের অন্তরে, আত্মতৃপ্তিতে।’

