মা
মৌলী আখন্দ
মুনমুন বিরক্ত মুখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকায়।
 “আলগা খাবার কবে থেকে শুরু করেছেন বললেন? ”
 “পনের দিন আগে থেইক্কা শুরু করছি। ”
 “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! আপনার বাচ্চার বয়স কত?”
 “আঠারো মাস!”
 “আঠারো মাস! মানে দেড় বছর? আর আপনি আলগা খাবার শুরু করেছেন মাত্র পনের দিন ধরে? ”
 “হ আফা!”
 “এই এক বছর পাঁচ মাস পনের দিন ধরে বাচ্চা কী খেতো? শুধু বুকের দুধ?”
 “হ আফা!”
 সামনে বসে থাকা ডক্টর আপা যে তার দিকে রেগে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে পারুল। কিন্তু তার মাথায় আসে না কেন রেগে যাচ্ছে! তার অপরাধটা কী?
 মুনমুন বিরক্তি লুকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি জানেন না যে বাচ্চার বয়স ছয় মাস হলে বাড়তি খাবার দিতে হয়?”
 “হ আফা!”
 “তাহলে দেননি কেন? ”
 “ছয় মাস হইলে পরে দিসিলাম! খায় না! ”
 “কী দিয়েছেন? ”
 “চাউলের গুঁড়া! ”
 “খিচুড়ি দেননি কেন? ”
 “দিসিলাম! খায় না! ”
 “অন্য কোনো কিছুই দেননি? ”
 “গরুর দুধ দিসিলাম! পরে পাতলা পায়খানা হইসিলো। হাসপাতালে ভর্তি লাগসে। পরে ডাক্তাররা মানা করসিল গরুর দুধ খাওয়াইতে। ”
 মুনমুন হাল ছেড়ে দেয়। না, সে আর মাথা ঘামাতে চায় না। এদের সমস্যার শেষ নেই। সে তার হাতের এক্সরেতে মনোযোগ দেয়। বাচ্চাটার পা বাঁকা দেখে সে ভর্তি করে ইমার্জেন্সি এক্সরে করিয়েছিল।
 এক্সরেতে কিছু একটা দেখে সে উত্তেজিত হয়ে যায়।
 “আপু, একটা রিকেটস (ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত বাচ্চাদের রোগ) এসেছে। কালকে মর্নিং সেশনে প্রেজেন্ট করবো? ”
 সি এ আপু এক্স রে দেখে বলেন, “করতে পার।”
 “বাচ্চার ম্যালনিউট্রিশনও আছে। দেড় বছর বয়সে ছয় কেজি ওজন!”
 “z score কতো? ”
 মুনমুন হিসাবে লেগে গেলো।
 “ম্যালনিউট্রিশন থাকলে তো ফিডিং হিস্ট্রি ডিটেইলস নিতে হবে। ডিটেইলস হিস্ট্রি নিতে থাকো আমি নাস্তা করে আসছি। ”
 “নিচ্ছি আপু।”
 মুনমুন মাকে নিয়ে পড়লো এবার।
 “মা, ও দিনে কতো বার বুকের দুধ খায়? ”
 “চাইরবার।”
 “আর, বাড়তি খাবার কী কী খাওয়ান?”
 “চাউলের গুঁড়া। ”
 “আর কী?”
 “আর কিছু না।”
 “চালের গুঁড়া কতো বার খাওয়ান?”
 “দুই বার।”
 “ব্যস? সারা দিনে চারবার বুকের দুধ, দুই বার চালের গুঁড়া? আর কিছু না? খেয়ে পেট ভরে? ”
 শ্বাস ফেলে পারুল বলে, “না আফা, ভরে না! কিতা করতাম, আমি তো মাইনষের বাইত কাম করি, আমি তো হ্যারে রাইখ্যা যাই, কামের বাইত লইয়া গেলে তো হ্যারা আমারে আর কামে রাখতো না! ”
 “কেন, বাচ্চার বাবা? ”
 “হ্যায় তো আরডা বিয়া করছে! হ্যারে কই পায়াম?”
 ছায়া নেমে আসে মুনমুনের চোখে। তাকিয়ে দেখে সে, মেয়েটির বয়স কতো হবে? আঠারো বছর? ঊনিশ বছর? এর মধ্যেই তার কোলে দেড় বছর বয়সের অপুষ্ট বাচ্চা, এবং তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে! তার রাগ কমে গিয়ে গভীর বিষাদে রূপান্তরিত হতে থাকে।
 “এক্সকিউজ মি!”
 মুনমুন তাকিয়ে দেখে পোশাকে ফিটফাট আধুনিক-শিক্ষিত একজন মহিলা তার সামনে দাঁড়িয়ে। এই ক্লাসের লোকজন সচরাচর সরকারি হাসপাতালে পদধূলি দেন না।
 “বলুন? ”
 মহিলার নাকে সম্ভবত উৎকট গন্ধ এসে লাগছে। তাঁর নাক কুঁচকানো। হতেই পারে, মুনমুনরা সারাদিন ধরে থাকে বলে হয়তো টের পায় না। এধরণের পশ লোকজন এলে তাদের নাকে গন্ধ লাগতেই পারে।
 “আপনি কি ইন্টার্নি? ”
 মুনমুন বিরক্ত হয়। প্রথম কথা, সে মোটেই ইন্টার্নি নয়, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি। দ্বিতীয় কথা, তিনি “ইন্টার্নি ” শব্দটা উচ্চারণ করেছেন মুখে তাচ্ছিল্য এনে। প্রথম দর্শনেই মহিলাকে অপছন্দ করে ফেলে মুনমুন।
“আপনার সমস্যাটা বলুন? ”
 “আমি আসলে মালিহা কাদির ম্যাডামকে দেখাতে এসেছি। ”
 নামটা শুনে নড়েচড়ে বসে মুনমুন।
 “আপনি মালিহা কাদির ম্যাডামের পেশেন্ট? ”
 “না, আমি উনাকে আগে কখনো দেখাইনি। ”
 “তাহলে? ”
 “আমি আমার বাচ্চাকে এখলাস স্যার, তালুকদার স্যার, আবিদ স্যার..’
 সব বড় বড় স্যার ম্যাডামের নাম উনি বলে যেতে লাগলেন আর মুনমুন চোখ বড় বড় করে শুনতে লাগলো।
 “এনাদের সবাইকে দেখিয়েছি। কিন্তু উপকার পাইনি। একজন বললো মালিহা কাদির ম্যাডামকে দেখাতে। আমি চেম্বারে উনার সিরিয়াল পাচ্ছিলাম না। তাই..”
 “উনি তো ভর্তি রোগী ছাড়া কোনো রোগী দেখবেন না। আপনি বহির্বিভাগে যান।”
 “আমার পরিচিত একজন ডক্টর আছেন, তাকে জানিয়ে এসেছি। উনি দেখিয়ে দেবেন বলেছেন। উনি আসছেন। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। ”
 “ওহ্ আচ্ছা। ”
 কেমন একটা কৌতূহল থেকে মুনমুন প্রশ্ন করে বসে, “কী সমস্যা আপনার বাচ্চার? ”
 “ও একদম খেতে চায়না। মুখে কোনো রুচিই নেই! ”
 মুনমুন বলে, “আসো তো বাবু, তোমার ওজন মেপে দেখি!”
 ওজন মেপে মুনমুনের চোখ কপালে উঠলো। দেড় বছর বয়সী মেয়ের ওজন ২২ কেজি!
 “কিছু মনে করবেন না মা, আপনার বাচ্চা তো ওভার ওয়েট!”
 ভদ্রমহিলা মুখ কালো করে ফেললেন।
 “কী কী খাওয়ান আপনার বাচ্চাকে?”
 “আমি অনেক হেলদি ডায়েট চার্ট ফলো করি।বসকাল আটটায় কলা, সকাল দশটায় ডিম, বেলা বারোটায় দুধ, দুপুর দুটোয় খিচুড়ি, বিকেল চারটায় দুধ, সন্ধ্যা ছয়টায় কর্ন ফ্লেক্স, রাত আটটায় নুডলস, রাত দশটায় খিচুড়ি, রাত বারোটায় দুধ।”
 এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন তিনি।
“এতো কিছু খায় বাবু! তাহলে তো ঠিকই আছে! ”
 মহিলা বিরক্ত মুখে বললেন, “কোনো খাবারই তো শেষ করে না! কলা আগে একটা খেতো এখন অর্ধেকটা খায়! খিচুড়ি আগে এক ফিডিং বোতল ভরে খেতো, এখন অর্ধেকটা খায়!”
 মুনমুন চোখ কপালে তুলে বলে, “খিচুড়ি ফিডিং বোতল ভরে দেন?কেন? কেউ বলে নি এটা করা যাবে না? ”
 “বলেছে।”
 “তাহলে? ”
 “ফিডিং বোতলে করে না দিলে খেতে চায়না। ”
 “বাচ্চা কি বাইরের কিছু খায়?”
 “খায় মাঝে মাঝে, চকোলেট,চিপস.. ”
 “ফাস্ট ফুড?”
 “ওই মাঝে মাঝে, আমাদের সাথে, দুই এক কামড়..”
 “তাহলে তো ওর পেট ভরাই থাকে! খাবে কীভাবে? ”
 “আপনি এতো কথা বলছেন কেন? আমি তো আপনাকে দেখাতে আসিনি! আমি মালিহা কাদির ম্যাডামকে দেখাতে এসেছি! ”
 এই কথায় মুনমুনের বোধ হয় অপমান বোধ করা উচিত ছিল। কিন্তু তার দৃষ্টি চলে যায় একটু দূরে বসে থাকা সেই আগের রিকেটসের বাচ্চার দিকে। তাকিয়ে তার নিজের বাচ্চার কথা মনে পড়ে যায়। তার নিজের মেয়ের বয়সও দেড় বছর। ওজন কমে গেছে। তার ওজন নয় কেজি।
 মুনমুন চোখ মেলে দেখতে থাকে বাসায় কাজ করে সেই গৃহকর্মী মায়ের রিকেটস আক্রান্ত অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চাটিকে। সেই মাও সেই মুহূর্তে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়।
 পারুল বুঝতে পারে ডক্টর আপা তার সাথে রেগে গিয়েছিল, তার বাচ্চাকে সে ঠিকমতো খাওয়ায়নি বলে।
তারপর তার বাসায় কাজ করা শুনে সেই রাগ কমেছে। সে ডক্টর আপার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, আপার রাগ পুরোপুরি কমে গেলে সে জিজ্ঞেস করবে হাসপাতালে কতো দিন থাকতে হবে। সে আজকে আর কালকে দুই দিন ছুটি নিয়ে এসেছে। পরশু দিন কাজে না গেলে তার কাজ থাকবে না। সে বেকার হয়ে যাবে।
 চোখে দুশ্চিন্তা নিয়ে মুনমুনের দিকে তাকিয়ে থাকে পারুল। আর পারুলের দিকে তাকিয়ে মুনমুন ভাবতে থাকে, আসার সময় মেয়েটার জ্বর দেখে এসেছিলাম, জ্বর কি কমেছে?
 অন্যদিকে মিসেস জাহানারা বিরক্ত মুখে মুনমুনের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, এসব ডক্টররা মানুষকে মানুষই মনে করে না! তার বাচ্চার সমস্যাটা কেউ গুরুত্বই দিচ্ছে না!
 তিনটি ভিন্ন পরিমণ্ডলের তিনজন মা নিজের বৃত্তের ভেতরে ভাবতে থাকেন।

