বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার মু. আকিবুর রহমান।
বাঁশখালীর কৃতি সন্তান এই তরুণ বিমান অফিসারের বাড়ি পুকুরিয়ার নাটমুড়া গ্রামে।
তার সামরিক জীবনের আবেগঘন লুকানো গল্পই আজকের আয়োজন।
!…..আশেপাশের চারঘর ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু আমাদের ঘরের মানুষ গুলো ঘুমোতে পারছেনা … আজও পরিষ্কার মনে পড়ে সেই রাতগুলোর কথা । ঐ রাতগুলোর সব মানুষ এখন রাতে ঘুমোতে পারে। কোন চিৎকার চেচামেচি নেই। সবাই ঠিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে । আবার সকালের ঘুমভাঙে এককাপ গরম চায়ের সাথে। তবে একজন মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে চিরতরে; ওনি আর ঘুম থেকে ওঠবেননা। আর অন্য কারোর ঘুমের ডিস্টার্বের কারণ ও হবেন না। এভাবেই আমাদের এতিম করে পরদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বাবা। বাসায় দেরি করে ফেরার জন্য বকাও শুনতে হয়না। শুক্রবারে বাড়িতে গিয়ে ওনার কাছে রিপোর্ট করে আসি যে “ ওনার ছেলে এখনও ভাল পথে আছে। এরপর কয়েকদিনের মাথায় এইসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগের দিনে ছিল দেশের বাড়িতে বাবার শোকসভা। বক্তব্যের মাধ্যমে স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বাসায় ফিরলাম রাত ০৯:৩০ ঘটিকায়;পরদিন সকালেই বাংলা ১ম পরীক্ষা। বাকী কদিনের গল্প শুধু চোখের পানি নিয়ে। সবার আড়ালে কেঁদেছি। বন্ধুবান্ধব কাউরেই বুঝতে দেইনি যে বাবা হারানো কষ্টে আছি। এরপর আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হতে লাগলো। এইসএসসি পরীক্ষার পর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সুযোগ পেয়েগেলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার পদে। পরে যোগদিলাম বিমান বাহিনীর অফিসার পদে ট্রেনিং করার জন্য। এই চাকরী করে হয়তবা দেশ শীর্ষ ধনীর আমার তালিকায় আমার নাম উঠাতে পারবোনা। তবে যতোদিন বাঁচবো রাষ্ট্রীয় সম্মান নিয়ে বাঁচব। আর মারা গেলে দেশের সামরিক পতাকা কাফনের উপর মুড়িয়ে আল্লাহর কাছে যাব।
চাকরী পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম. তার চেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল এই কারণে যে; বাবাকে কানে কানে গিয়ে বলতে পারলাম না যে বাবা দেখো ! -“তোমার অকর্মণ্য ছেলেটা আজ মানুষ হওয়ার পথে…!” মনকে শক্ত করলাম। ইনশাআল্লাহ কমিশন পাওয়ার পর সামরিক পোশাকে বাবার কবরের সামনে মনে মনে বিগল বাজিয়ে সম্মান সালাম দিয়ে বলব দেখো বাবা-“ তোমার ছেলে আজ দেশ রক্ষায় নিয়োজিত। আমাকে নিয়ে তোমার আর চিন্তা করতে হবেনা”। এই আশাটুকু বুনিয়ে ট্রেনিং করে যাচ্ছি।
এক বিকেলের প্রেপ আওয়ারে পড়তে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে এসব কথাই লিখছিলাম। রুমমেট অফিসার ক্যাডেট আজিম কোন পলকে যে সে আমার লিখা পড়ছে আমি টেরই পেলাম না। দেখছি সে গণিত করার অভিনয় করছে আর তার চোখ দিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, ভাবলাম আমার শোকে সেও শোকাহত! । আমার ভাবনা কিছুটা ভুল হল !! অফিসার ক্যাডেট আজিমের বাবাকেও আমার বাবার মত কেঁড়ে নিয়েছে মরণব্যধি ক্যান্সার! কষ্টে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা।
সকাল ০৫ টা থেকে শুরু করে রাত ১১ টায় থামে আমাদের দিন। পিটি, প্যারেড,ফ্লাইং,ফায়ারিং, পড়াশোনা, খেলাধূলা এসবের মধ্যে আমাদের ব্যস্ত জীবন। নিজের পরিবার থেকে প্রায় ১০০০ কি.মি. দূরে এসে ঘামঝরা পরিশ্রম করে যাচ্ছি শুধু দেশরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছি বলেই। ছুটির দিন গুণতে গুণতে এরিমধ্যেই চলে এল প্যাক আপ করার ঘোষণা। স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার, আর তর সইছেনা। প্রিয়জনের সাতে দেখা হবে বহুদিন পর। ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে উঠব আমরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। ঢাকা পার্টি বিমানে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছি। সামনে পড়ল ফ্লাইট ক্যাডেট শাকিল – “দোস্ত আন্টিকে আমার সালাম দিস‘আর দোয়া করতে বলিশ”। মাথ নিচু করে একটা মিচকা হাসি দিল; আর হেসে বলল “দোস্ত আমার ‘মা নেই !! কিছুদিন আগে মারাগেছে” –থমকে গেলাম তার কথায়, স্যরি বলতে পারলাম না। মনে করতাম ট্রেনিংএ শুধু আমিই এতিম ! আমার এমন ভাবনায় হলো আবারও ভূল !! আচ্ছা যা‘ই হোক ..! এরি মধ্যে চলে এলাম চট্টগ্রামে। মনে আনন্দের জোয়ার, ঈদের ছুটি ! সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করব। ঈদের সকাল বেলা আবারো মনমরা হয়ে গেলাম। গেল বছর ঈদে বাবা আর আমি একই রুমে ড্রেসআপ করতাম; একজনের পাজামা আরেকজন পড়ে বসে থাকতাম যখনি বুঝতে পারতাম দাঁত কেলিয়ে বলতাম “বাবা পাজামাতো একই কিন্তু চেইঞ্জ হয়েছে। দিনগুলো অনেক মজার ছিল। যা আজকের এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ। এর আগের বছর ঈদের দিন হারালাম খালাতো ভাই ‘ইকবাল কে। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীর ফাইনাল টার্ম ক্যাডেট ছিল। কদিন পরেই অফিসার হয়ে বের হবে। এমন সময় গ্রামের বাড়ির পুকুরে ঈদের গোসল করতে গিয়ে ডুবে মারা যায় ! একের পর এক হারানো গল্প !! ভাইহারা ইকবালের বোন ‘বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন। ছোট বেলায় হারিয়েছেন বাবাকে। এরপর হারালেন একমাত্র ভাইকে। হারানোর ব্যাথা সামরিক পোশাকের ভেতর লুকিয়ে প্রতিদিন ডোরা দাগকাটা সবুজ পোশাকে বেরিয়ে পড়েন দেশরক্ষার কার্যে।
আচ্ছা থাকনা এসব..! শুধু মৃত্যু আর হারানোর কথাই বলছি। না, আর বলব না !
ছুটি শেষে ফিরে এলাম আসল পরিচয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একাডেমীতে। সবকিছু ভুলে আবারো ব্যস্ত কর্মজীবনে নেমে পড়লাম। ফোর্থ টার্ম স্যারদের ফ্লাইং শুরু হয়েছে। রুবাইয়াত স্যারকে কাভারোলে (পাইলট পোশাক) দেখে মুচকি হাসি দিয়ে বললাম “স্যার,ইউ আর লুকিং গুড”। হেসে উত্তর দিল “ভাই আর কইস না, জিডিপির ট্রেনিং অনেক কষ্ট রে “।
দুদিন যাবত রুবাইয়াত স্যারকে দেখিনা। ভাবলাম অসুস্থ আছেন ,সিক রিপোর্ট এর জন্য গেছেন…, না ! না! আমার ধারনা ভূল। স্যার ইমারজেন্সি লিভ এ আছেন। আজিমের কাছে জিজ্ঞেস করলাম “রুবাইয়াত স্যারের খবর জানিস?”-চুপকরে রইল কিছুক্ষণ ‘আজিম। মাথা নিচুকরে ভাঙা গলায় বলল –“স্যারের বাবা মারা গেছেন !”-“কিহহহ !” আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়। এসব যখন শুনি নিজেকে বেশি এতিম মনে হয়। একাডেমিক ক্লাস থেকে রুমে আসা পর্যন্ত চোখ দিয়ে শুধু পানি‘ই গেল। ৭দিন পরেস্যার আবার একাডেমীতে চলে এসেছেন ট্রেনিং এ যোগদিতে। যেদিন স্যার প্রথম PT-6 প্রশিক্ষণ বিমান চালান রানওয়েতে ‘তারপর দিন-ই বাবাকে হারালেন। ছেলের বিমান চালানোর কথা শুনে এই পৃথিবীতে বাবার থেকে খুশি বেশি কেউ হবেন না। স্যার ‘বাবাকে এই খুশির সংবাদটুকু দিতে পারেননি ! তবুও ওনি আজ থেমে নেই। দেশরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন কাধে।
এরকম আমরা কেউ বাবা,কেউ ‘মা,ভাইবোন, প্রিয়জন হারেয়িছি। এত অল্প বয়সে এত কিছু হারানোর কথা ছিলনা। ব্যাথা বুকে চেপে প্রতিদিন ডোরাকাটা পোশাকে অস্ত্র হাতে এগিয়ে যাচ্ছি প্যারেড গ্রাউন্ডে। শপথ নিচ্ছি দেশ রক্ষার। নিজের পরিবার থেকে দূরে এসে শিখছি কিভাবে হাজারো ‘মা-বাবাকে রক্ষা করতে হবে। এভাবেই মাটি আর আকাশে এগিয়ে যাই.. আর হুংকার দিয়ে বলি –“জল,স্থল ও আকাশ পথে… সর্বত্র আমার দেশের তরে”।
__________________________
মো. আকিবুর রহমান
অফিসার ক্যাডেট
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী
বি.দ্র: লেখাটা অনুমতি ছাড়া কপি না করার অনুরোধ করা যাচ্ছে।